মাথা নিয়ে যত ব্যাথা:
এমন মানুষ একজনও হয়তো পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার কখনও জীবনে মাথা ব্যাথা হয়নি। মাথা ব্যাথা নিয়ে সকল প্রশ্নের উত্তর দিতেই আজকের এই আয়োজন।
১. মাথা ব্যাথা কি? মাথা ব্যাথা কি শুধু মাথায়ই হয়?
মাথা ব্যাথা বলতে, মাথা, মুখ মন্ডলসহ ঘাড়ের উপরিভাগের যেকোন অংশে ব্যাথা, অস্বস্তি, অসাড় অবস্থা ইত্যাদি বোঝায়।
রোগী কি বলেঃ মাথায় ব্যাথা, টনটন, শিনশিন, ঝিনঝিন, ঝিমঝিম, জিলকানো, মাথায় গরম আগুনের মত অনুভূতি, মাথায় ধোঁয়া, মাথায় জ্যাম হওয়া, মাথা হ্যাং হওয়া ইত্যাদি।
২. মাথা ব্যাথা কত প্রকার? মাথা ব্যাথা হলেই কি সেটা মাইগ্রেন? মাথা ব্যাথা হলেই কি সেটা ব্রেইন টিউমার?
সহজ ভাষায় বললে, মাথা ব্যাথা মূলতঃ দুই প্রকার
ক) প্রাইমারি হেডেক- ৯৭%
খ) সেকেন্ডারি হেডেক – ৩%
প্রাইমারি হেডেকঃ
যে সকল মাথা ব্যাথায় পেছনে সুনির্দিষ্ট কোন কারণ থাকে না। যেমন- ক) টেনশন টাইপ হেডেক
খ) মাইগ্রেন
গ) মিক্সড
সেকেন্ডারি হেডেকঃ
যে ধরনের মাথা ব্যাথার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ বিদ্যমান। যেমন- ব্রেইন টিউমার, স্ট্রোক।
আবার অন্যভাবে সময়ের প্রেক্ষিতে বললে ক) একিউট হেডেক, খ) ক্রনিক হেডেক
৩. মাথা ব্যাথা কেন হয়?
সাধারণত ৯৭% মাথা ব্যাথার সুনির্দিষ্ট কোন কারণ থাকে না।
সাধারণ ভাবে বয়স, হরমোনের প্রভাব, দৈনন্দিন কাজের স্ট্রেস, অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচরণ, অনিদ্রা, অস্থিরতা, মোবাইল বা টিভি আসক্তি, খাদ্যাভ্যাস (কফি, চকলেট, কোকো জাতীয় পদার্থ, এলকোহল জাতীয় পানীয়), দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকা, অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা ইত্যাদি অনুঘটক হিসাবে কাজ করে।
আর সেকেন্ডারি হেডেকের কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ আছে, যেমন ব্রেইন টিউমার, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, মস্তিষ্কের অন্তর্নিহিত প্রেশার বৃদ্ধি ইত্যাদি।
৪. কিভাবে বুঝবো, আমার মাথা ব্যাথা মাইগ্রেন নাকি ব্রেইন টিউমারের লক্ষ্মণ?
পরীক্ষা নিরিক্ষা ছাড়া এটা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও সাধারণ ভাবে লক্ষণ দেখে মাথা ব্যাথার টাইপ বা কারণ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা সম্ভব
- ক) মাইগ্রেনঃ অনকেই মাথা ব্যাথা বলতে সাধারণত এই রোগটিকে বুঝিয়ে থাকেন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ধারণা ভুল।
মাইগ্রেন হলে সাধারণত তীব্র বা মাঝারি তীব্রতার ব্যাথা, মাথার এক দিক থেকে শুরু হয়। যদিও সেটা অন্য দিকেও যেতে পারে। মাথায় এক দিকে দবদব অনুভূতি। রোগীরা অনেক সময় বলেন যে মাথার এক পাশে রগ লাফায়। সাথে বমি বা বমিবমি ভাব, মাথা ঘোরা, আলো, শব্দ শুনতে খারাপ লাগা ইত্যাদি অনুভূতি থাকতে পারে। কেউ কেউ আবার মাথা ব্যাথা উঠবে এটা আগে থেকেই বুঝতে পারেন৷ তাদের অনেক সময়, বমি ভাব, চোখে ঝাপসা দেখা, চোখে তারা ঝিলমিল বা আলোর ঝলকানি অনুভূতি হয়। মাইগ্রেনের ব্যাথা এক বার উঠলে সাধারণত ৪ ঘন্টা থেকে ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এটা সপ্তাহে কয়েকদিন থেকে মাসে কয়েকবার পর্যন্ত হতে পারে৷ তবে সাধারণ ভাবে একবার উঠলে তা কোন ভাবেই ১৫ দিনের বেশি স্থায়ী হবে না। - খ) টেনশন হেডেকঃ
টেনশন হেডেক বা মাসল কনট্রাকশন হেডেকে মৃদু বা মাঝারি তীব্রতার ব্যাথা হয়, পুরে মাথা কিংবা দুই পাশ এক সাথে, অথবা মাথার পেছনের অংশে হয়। মনে হয় যেন মাথা ভারী হয়ে আছে বা মাথায় কোন কিছু ব্যান্ডের মতো চেপে আছে। সাধারণত বমি ভাব হলেও বমি হয় না। আলো বা শব্দে খারাপ লাগে না। তবে রোগীর ভাষায় কখনো মনে হয় মাথা জ্যাম হয়ে আছে
এ ধরনের ব্যাথা সাধারণত কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে।
এগুলো সাধারণত মানসিক চাপ, অস্থিরতা, কর্মক্ষেত্রে বা পারিবারিক স্ট্রেস, অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচরণ, অনিদ্রা ইত্যাদির সাথে যুক্ত থাকে
এখানে উল্লেখ্য যে, প্রাইমারি হেডেেক কোন মৃত্যু ঝুঁকি নেই। - গ) সেকেন্ডারী হেডেকঃ
সাধারণত মাঝারী থেকে তীব্র মাথা ব্যাথা, মাথার একপাশ বা দুই পাশ, প্রতিদিনই হয়, সাথে বমি থাকতে পারে, চোখে ঝাপসা দেখা কিংবা চোখে সবকিছু দুইটা দেখে মনে হতে পারে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে বা হাঁচি কাশি দিলে ব্যাথা বাড়ে, প্রতিদিনই থাকে, দিনদিন তীব্রতা বাড়তে পারে। খিঁচুনি বা এক পাস অবশ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থাও হতে পারে। এমন হলে ব্রেইন টিউমার একটা সম্ভাবনা হতে পারে। আর যদি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোকের কারণে হয় তবে হঠাৎ তীব্র ব্যাথা (মাথায় বজ্রপাতের মতো), এর সাথে বমি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি হওয়া, মুখ ও শরীরের এক অংশ অবশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষ্মণ দেখা দিতে পারে।
আপনার লক্ষণ যদি সেকেন্ডারী হেডেকের সাথে মিলে যায় তবে বুঝতে হবে এ রোগের কারণে মৃত্যু ঝুঁকি আছে এবং আপনার দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বিশেষভাবে স্ট্রোক জনিত মাথা ব্যাথা সন্দেহ হলে অতি দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের স্মরণাপন্ন হতে হবে।
৫. কখন মাথার সিটি স্ক্যান বা এম আর আই করতে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর সকল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বিশেষ করে নিউরোলজিস্টগণ খুব ভালোভাবেই জানেন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজে থেকে কখনোই সিটি স্ক্যান করাবেন না। যদি কোন চিকিৎসক আপনার মাথা ব্যাথার লক্ষ্মণ দেখে এবং আপনার নিউরোলজিকাল এক্সামিনেশন করে বুঝতে পারেন যে এটা সেকেন্ডারি হেডেক তবে তিনি অবশ্যই সিটি স্ক্যান বা এম আর আই করাবেন।
চিকিৎসকগণ আপনার চোখের রেটিনা ও ফান্ডাস পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন আপনার এ ধরনের পরীক্ষার প্রয়োজন আছে কিনা
৬. কোনটা ভালো, সিটি নাকি এম আর আই?
সিটি না এম আর আই প্রয়োজন সেটা নির্ভর করে, কোন কারণ আমরা সন্দেহ করতেছি
স্ট্রোক সন্দেহ হলে সিটি স্ক্যান আর ব্রেইন টিউমার সন্দেহ হলে এম আর আই করা ভালো।
তবে এটা অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে
৭. মাথা ব্যাথা হলে কি করনীয়?
মৃদু থেকে মাঝারী তীব্রতার মাথা ব্যাথা, প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধেই সাধারণত চলে যায়। তবে তীব্র ব্যাথা হলে টলফেনামিক এসিড, ন্যাপ্রোক্সেন সোডিয়াম ইত্যাদি ব্যাথা নাশক ঔষধ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করতে হবে
কিছু সংখ্যক মাইগ্রেন রোগী ব্যাথা হওয়ার আগেই কিছু উপসর্গ দিয়ে বুঝতে পারেন যে ব্যাথা উঠবে, যেমন চোখে আলোর ঝলকানি বা তারা ঝিলমিল দেখা, ঝাপসা দেখা, মাথা ঘুরানো ইত্যাদি। এসময়ের মধ্যে ট্রিপটান জাতীয় ঔষধ নাকে স্প্রে করে বা মুখে খেলে ব্যাথা দূর করা সম্ভব
৮. মাথা ব্যাথা দূর / নিরাময় কিভাবে করবো?
মাথা ব্যাথা দূর করার জন্য ঔষধ ছাড়াও আরো কিছু ব্যবস্থা নিজেকে নিতে হবে
- নিয়ন্ত্রিত জীবনাচরণ
- প্রতিদিন সকালে হাঁটা
- সময় মত খাবার গ্রহণ
- কিছু খাবার পরিত্যাগ- কফি, চকোলেট, আইসক্রীম, বাদাম, এলকোহল জাতীয় পানীয়
- দীর্ঘক্ষন মোবাইল, টিভি স্ক্রীন ব্যাবহার না করা
- পরিমাণ মতো পানি খাওয়া ( ডিহাইড্রেশন মুক্ত থাকা), অতিরিক্ত গরমে নিজেকে হাইড্রেট রাখা
- অতিরিক্ত ঠান্ডা পরিহার করা
- ঔষধ : নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী দীর্ঘ মেয়াদী প্রতিরোধক চিকিৎসা গ্রহণ করা